মোঃ ওয়াজেদ আলীঃ পদ্মা বিধৌত সদরপুর উপজেলাটির দিয়ারা নারিকেল বাড়িয়া,চরনাছিরপুর ও চর মানাইর ইউনিয়ন পুরোপুরি নদীর বুকে এবং আকট ও ঢেউখালী ইউনিয়নের বেশ কিছু অংশ বিভিন্ন নদীর কোল ঘেঁষে অবস্হিত।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পদ্মা নদী,আঁড়িয়াল খাঁ নদ ও ভূবনেশ্বর নদী এসব ইউনিয়নের উপর দিয়ে বয়ে গেছে।
এসব নদীর ভাঙ্গন ও জলাবদ্ধতার কারণে এই অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। প্রতি বছর শীত এলে ঝাঁকে ঝাঁকে এসব পাখি নদীর জলে ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ কাশবন এলাকায় বাসা বাঁধে।এ এলাকাগুলি দূূর্গম ও জনমানবহীন হওয়ায় পাখিরা নির্বিঘ্নে বসবাস করতে পারে।
মাঝে মাঝে শিকারী প্রানী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে বহু পাখি মারা যায়।গুপ্তচর পাখি শিকারীর দ্বারাও অনেক সময় এই পাখি শিকার করতে দেখা যায়। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, এক দশক আগেও এদেশে ২০০ থেকে ২১৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসত। এ সংখ্যা প্রতি বছর ব্যাপকহারে হ্রাস পাচ্ছে।পাখি শিকার ও জলাভূমির সংখ্যা কমে যাওয়াই এর মুল কারন বলে পরিবেশবিদদের ধারনা।
গ্রামের গরিব মানুষ পেটের দায়ে পাখি শিকার করে বিক্রি করে।এক্ষেত্রে জনসচেতনতা ও প্রকৃতিপ্রেমই দরকার সবচেয়ে বেশি।
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২
( ২০১২ সনের ৩০ নং আইন ) (১) কোন ব্যক্তি তফসিল ১ ও ২ এ উল্লিখিত কোন পাখি বা পরিযায়ী পাখি হত্যা করলে তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ১ (এক) বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ (এক) লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ ২ (দুই) বৎসর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ ২ (দুই) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
এমন কঠোর আইন থাকা সত্বেও এক শ্রেনীর অসাধু পাখি শিকারী প্রশাসন ও জনগনের অন্তরালে পাখি শিকার করছে বলে একাধিক লোকের মুখে শোনা যায়।
কয়েকটি পাখি সংরক্ষণকারী সংগঠনের সাথে কথা বলে জানা যায়,পাখি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে তারা বদ্ধ পরিকর।
চরনাছিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ রোকন উদ্দিন মোল্লা বলেন,আগে আমাদের এলাকার নদীগুলিতে প্রচুর অতিথি পাখি আসলেও কয়েক বছর যাবৎ তুলনামূলক পাখিদের আগমন ঘটে কম।নদীর নাব্যতা ও পরিবেশের ভারসাম্য পরিবর্তন এর অন্যতম কারন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ঢেউখালী ইউনিয়নের চরডুবাইলের বিলে শত শত অতিথি পাখি এসেছে বেড়াতে।পুরো বিল এখন পাখিদের আনাগোনায় মুখরিত। উক্ত ইউনিয়নের ম্যারিজ রেজিস্ট্রার মোঃ আবুতালেব সরদার বলেন উক্ত বিলে আমার একটি মৎস্য খামার রয়েছে।ঝাকে ঝাকে পাখিরা নিয়মিত বিলে আসে বিচরন করে ও খাদ্য সংগ্রহ করে। কেউ যেন শিকার করতে না পারে এ ব্যাপারে আমরা সচেতন আছি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।এ ছাড়াও ভাষানচর ইউনিয়নের খেজুর তলা সহ বিভিন্ন বিলে অতিতি পাখি এসেছে এবারের শীতে।
এ ব্যাপারে ফরিদপুর জেলা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ সাইদ আনোয়ার বলেন,পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র্য রক্ষা করে। এই প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সবার সচেতনতা ও পাখিদের প্রতি ভালোবাসা তৈরী করতে হবে।
তবে কেউ যদি পাখি শিকার করে তাহলে তাকে আইনের আওতায় আনারও পরামর্শ দেন তিনি।
শীত এলেই নাম না জানা হরেক রকম রং-বেরঙের পাখিদের আগমনে ভরে যায় বাংলাদেশের হাওড়,বাওড়,বিল,পুকুর,দ্বীপ,উপদ্বীপ সহ বিভিন্ন জলাশয়।শুধুমাত্র শীত এলেই এরা আমাদের দেশে আসে বলে আমরা এদেরকে বলি ‘অতিথি পাখি,পরিযায়ী পাখি বা যাযাবর পাখি।এসব পাখিদের বাচ্চা পালন ও বাসা তৈরির কৌশল বিচিত্র।ঝড়,বৃষ্টি,তুষারপাতসহ প্রকৃতির প্রতিকূলতা থেকে বাঁচতে ও শীত প্রধান দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশে তারা পাড়ি জমায় হাজার হাজার মাইল দূর থেকে।বিশেষজ্ঞদের মতে,বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে।
রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখি আসে এমন ধারনা থাকলেও এর মতভেদও রয়েছে।
এসব পাখি নিয়ে গবেষণা করেছেন পরিযায়ী পাখি বিশেষজ্ঞ সারোয়ার আলম দীপু। তিনি বলছেন রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে এসব পাখি আসে বলে যে তথ্য প্রচলিত আছে সেটি ঠিক নয়।
বরং পাখিগুলো উত্তর মঙ্গোলিয়া ও তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল,রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে আসে।অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা ও হিমালয় পর্বতমালার আশে পাশের এলাকা থেকেই পাখিগুলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসে যেখানে তুলনামূলক কম ঠাণ্ডা পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়।
প্রকৃতিগতভাবেই এই পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত ফলে এরা সাধারণত ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে উড়তে পারে।ছোট পাখিরা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারে এবং দিন-রাত মিলে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে পারে।আকারে বড় পাখিরা ঘণ্টায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেগে অনায়াসে উড়তে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো,এসব পাখিদের গন্তব্যস্থান নির্ণয়ের জন্য আলাদা কৌশল রয়েছে।
সাধারণত এরা সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে দলবেঁধে আসতে শুরু করলেও মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত কলকাকলিতে আমাদের প্রকৃতিকে বিমুগ্ধ রাখে।বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটলেও শীতের সময়ে সবচেয়ে বেশী দেখা যায়।এসব অতিথি পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হরিয়াল,রাজশকুন,লালবন মোরগ, তিলে ময়না, রামঘুঘু,জঙ্গি বটের,ধূসর বটের,হলদে খঞ্চনা,কুলাউ,চকাচকি, কার্লিউ, বুনো হাঁস, ছোট সারস, বড় সারস, হেরন, নিশাচর হেরন, ডুবুরি পাখি, কাদাখোঁচা, গায়ক রেন, রাজসরালি, পাতিকুট, গ্যাডওয়াল, পিনটেইল, নরদাম সুবেলার, কমন পোচার্ড, বিলুপ্তপ্রায় প্যালাস ফিস ঈগল (বুলুয়া) ইত্যাদি। এছাড়াও নানা রং আর কণ্ঠবৈচিত্র্যের পাখিদের মধ্যে রয়েছে ধূসর ও গোলাপি রাজহাঁস, বালি হাঁস, লেঞ্জা, চিতি, সরালি, পাতিহাঁস, বুটিহাঁস, বৈকাল, নীলশীর পিয়াং, চীনা, পান্তামুখি, রাঙামুড়ি, কালোহাঁস, রাজহাঁস, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি।
এসব পাখিদের আবাসস্থল সৃষ্টি ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন পাখি প্রেমিকেরা।