কে এম শাহীন রেজা, কুষ্টিয়া জেলা প্রতিনিধি ॥
আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে দলের লেবাস গায়ে লাগিয়ে জামাত-বিএনপি’র সাথে আতাত করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চার জেলায় এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শীর্ষ চরমপন্থি নেতা ও পুলিশ সহ একাধিক পোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় থাকা কুষ্টিয়া জেলার মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর কবির লিপটন। যদিও তিনি আওয়ামীলীগের কোন অঙ্গ সংগঠনের সাথে জড়িত নেই তবুও এই দলের লেবাস গায়ে জড়িয়ে তার নিজ এলাকা কুষ্টিয়া দূর্বচারা গ্রামে গড়ে তুলেছে চরমপন্থী সংগঠনের দূর্গ। এই চরমপন্থী সংগঠনকে সাথে নিয়ে হত্যা, মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবসার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই লিপটন মূর্তিমান আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত। তার ফোন পেলে ঠিকাদার, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের অনেকেরই ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। রাজধানীতেও নেটওয়ার্ক রয়েছে লিপটন বাহিনীর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাঘা বাঘা চরমপন্থি বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও লিপটন আছে বহাল তবিয়তে। প্রথমে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে বসেই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ করত। পরে সবকিছু ম্যানেজ করে দেশে ফিরে আবারও শুরু করে সন্ত্রাসী তৎপরতা। লিপটন বাহিনীর অত্যাচার থেকে পরিত্রাণে এবার রাস্তায় নেমেছে চার জেলা কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের সাধারণ মানুষ। লিপটন ও তার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ সমাবেশসহ হয়েছে নানা কর্মসূচিও। এতেও কাজ না হওয়ায় ভুক্তভোগীরা গত দুই বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছিল। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও সন্ত্রাসী লিপটনের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎই সবই স্থবির হল কেন? এ বিষয়ে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে তার সম্পর্কে আমাদের কাছে সকল তথ্য প্রমানাদি আছে সময়মত ব্যবস্থা নিব।
কে এই লিপটন : জেলা পুলিশের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী ও কুখ্যাত চরমপন্থি নেতা লিপটনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দুর্বাচারা গ্রামে। তার বাবার নাম আজিজুর রহমান। তার ছোট ভাই বাইরন প্রশাসন ক্যাডারের উপ-সচিব পদে কর্মরত আছে। ছোট ভাইয়ের ক্ষমতা বলে এই চরমপন্থী সংগঠন দাড় করিয়ে নানা কু-কুকর্ম করে বেড়াচ্ছে। জামায়াত আদর্শের পরিবারে বড় হওয়া লিপটন নব্বইয়ের দশকে কলেজে ভর্তির পরই চরমপন্থি দল গণমুক্তিফৌজে নাম লেখায়। সে সময় নিজে হাতে একের পর এক হত্যা মিশন চালিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুটার হিসেবে পরিচিতি পায়। একপর্যায়ে নিজেই বাহিনী গড়ে তোলে। ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া অভিযোগে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলে জেলা বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা, তৎকালীন সংসদ সদস্যের ছত্রছায়ায় টেন্ডারবাজি ও খুন-খারাবিতে মেতে ওঠে সে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জোরদার অভিযান শুরু করলে লিপটন ভারতে পালিয়ে যায়। এরপর অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ করে ২০১৩ সালে লিপটন দেশে ফিরে দীঘ এক যুগ ধরে আবারও চরমপন্থি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়। অভিযোগ রয়েছে, লিপটন স্থানীয় র্যাবের কিছু সদস্যকে হাত করে নিজেকে এ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত সোর্স পরিচয় দিয়ে থাকে। বর্তমানে কুষ্টিয়া শহরে কোন বড় মিটিং হলে তার চরমপন্থী সংগঠনের ক্যাডারদের নিয়ে মুখে মাক্স পরে শো ডাউন দিতে দেখা গেছে যুবলীগ ব্যানারে। যেন কেউ তাকে চিনতে না পারে।
তার যত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড : প্রায় আড়াই যুগ ধরে সন্ত্রাসী জগতে তৎপর লিপটন। শুরুতে বিভিন্ন অপারেশনে কিলার হিসেবে কাজ করত। নিজে প্রায় দুই ডজন হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সব মিলিয়ে অর্ধশতাধিক হত্যা মিশনের সঙ্গে তার সংশ্নিষ্টতা ছিল। অভিযোগ রয়েছে, ২০০২ সালে ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বিরোধে বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আক্তারুজ্জামান লাবুর ভাই জামাই বাবুকে গুলি করে হত্যা করে লিপটন ও তার তিন সহযোগীকে। যুবলীগ নেতা জামু ও ফয়েজ নামের আরও দুই ব্যবসায়ীকে ২০০৩ সালে লিপটনের নেতৃত্বে হত্যা করা হয়। ২০০৬ সালে থানাপাড়ার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান হাবিবকে হত্যা করে লিপটন। এছাড়া তার নেতৃত্বে শহরে মাথা কেটে ফেলে রাখার মতো লোমহর্ষক ঘটনা এখনও কুষ্টিয়াবাসী ভোলেনি। এর বাইরেও ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরেও নানা অপারেশনে নেতৃত্ব দিয়েছে লিপটন। এখনও তার কাছে প্রচুর অস্ত্রের ভান্ডার। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র এনে সে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে। এমনকি ওই অস্ত্রের চালান রাজধানীতেও আসে বলে অভিযোগ। এখনও নিয়মিত চাঁদাবাজি করে আসছে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের শতাধিক জিডি রয়েছে।
বর্তামান মিশন আওয়ামীলীগ নেতারা : বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় লিপটন বেছে বেছে আওয়ামী লীগ নেতা ও এই দলের অনুসারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই বেশি চাঁদা আদায় করেছে। চাঁদা না দিলে তারাই বেশি অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন। জামাই বাবু, জামুসহ আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা সে সময় খুন হন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তবে কিছুটা কৌশল বদলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সদর উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুল আলিম, কাঞ্চনপুর যুবলীগের আহ্বায়ক রাশিদুল ইসলাম (বর্তমান ইউপি মেম্বার), সাবেক নেতা হাবিবর রহমান ও ইমনকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। বর্তানে এখন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আ’লীগ নেতা সহ সাধারন জনগনের উপর। এসব ঘটনার প্রতিবাদে এলাকার হাজার হাজার সাধারণ নারী-পুরুষ বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন করে লিপটনের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিল কিন্তু কোন ফলাফল পায় নাই। যে কারনে লিপ্টন এখন আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে আ’লীগককে ঘায়েল করতে জামাত-বিএনপির সাথে হাত মিলিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে অনেক সূধীজনেরা মন্তব্য ছুড়েছেন বিতর্কিত এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে।
সাম্প্রতিক ঘটনা : ২০১৩ সালে ভারত থেকে ফিরে এসে দীর্ঘ এক যুগ ধরে নতুন মিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এই সূচতুর লিপটন। সে এক যুগ ধরে ‘মানুষ খুঁন নয়’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনা মতে শতাধিক কর্মীকে মাসিক বেতন দিয়ে অস্ত্র তুলে দিয়ে চাঁদাবাজি, ভয়ভিতি, ডাকাতি, অপহরন করে মুক্তিপন আদায়, প্রশাসনকে ধরিয়ে দিয়ে অর্থ আদায়, তার নিজ এলাকায় সন্ত্রাসী তান্ডবলীলা চালিয়ে লুটপাট করাই এখন তার মূল কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারছিল না। কারন মানুষ করলে তাকে এলাকা থেকে পালাতে হবে নইলে প্রশাসনের কাছে ধরা পড়তে হবে। ২০১৩ সালের পর থেকে তার তো কোন ইনকাম নেই এগুলো করে নিজে খাচ্ছে তার পোষ্য বাহিনীদের বেতন দিচ্ছে। তার বাহিনীতে একজন আছে পাশ^কর্তী বরইটুপি গ্রামের নিকবার নামের এক সন্ত্রাসী সে এক সময় কমিউনিষ্ট পার্টির মফিজের সাথে কাজ করতো সেই সময় মফিজের একটি সাটারগান গায়েব করে দেয়, সেটি বর্তমানে এখনো তার কাছেই আছে ওটা দিয়েই লিপটনের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এলাকাবাসী, সম্প্রতি মামলার কপি ও আটককৃত আসামীদের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে জানা গেছে তাদের বাড়ী দূর্বাচারাতে নয়। তারা আশপাশের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তারা অর্থের বিনিময়ে লিপ্টনের সন্ত্রাসী বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।
এই সন্ত্রাসী লিপ্টন তার বাহিনী দিয়ে গত ৬/৭ মাস আগে থেকে তার নিজ এলাকাতে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। তাদেরকে প্রতিহত করতে এলাকাবাসীও মামলার স্বীকার হয়েছে। আর এ সংঘর্ষের পেছনে কলকাঠি নাড়াচ্ছেন তারই আপন ছোট ভাই উপ-সচিব বাইরন। গত ২৬ তারিখের যে ন্যক্কার জনক ঘটনার পেছনেও তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে আতংকিত দূর্বাচারার বাসিন্দারা। ঐ ঘটনার দিন ইবি থানা পুলিশ ১৪ জনকে আটক করলেও বাকী আসামীদের এখনো আটক করতে ব্যর্থ হয়েছেন। গত ১৮ আগষ্ট ঐ এলাকার কুদ্দুস খাঁকে নির্মমভাবে কুপিয়ে জখম করেছিল তার সন্ত্রাসীরা ঐ সময় লিপ্টন দেশের বাইরে থাকায় তার নামে মামলা হয় নাই। তবে তার নির্দেশেই এই জঘন্যতম ঘটনা ঘটিয়েছিল। গত কয়েকদিন আগে উজানগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান ছানোয়ার মোল্লাকে প্রানে মারতে গিয়ে জনগনের হাতে ধরা খায় ঐ সন্ত্রাসী। তবে কুষ্টিয়া প্রশাসন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ তুলেছে। তার বিরুদ্ধে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে এসেছে, আগামী পর্বে দেখার জন্য চোখ রাখুন।