কোরবানিকে সামনে রেখে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরে পোনা নদীর পশ্চিম পাড়ে জমে উঠেছে সর্ববৃহৎ পশুর হাট। পিরোজপুরের ৭ উপজেলার ৫২টি ইউনিয়ন চার’টি পৌরসভা মধ্যে প্রায় ৪২টি স্থানে বসে গরুর হাট। সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে, পোনা নদী পশ্চিম পাড়ে ভান্ডারিয়া উপজেলার নদমুলা ইউনিয়নের দক্ষিণ শিয়ালকাঠীর লিয়াকত মার্কেট হতে ধাওয়া ইউনিয়নের ফুলতলা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার দুই পার্শ্বে বিক্রেতারা কোরবানির গরু নিয়ে বসেছে বিক্রির জন্য। স্থানীয় খামারী এবং যশোর, ঝিনাইদাহ, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষিরাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা গরু নিয়ে এসেছে বিক্রির জন্য। আর তা কিনতে ভান্ডারিয়া উপজেলা ছাড়াও পাশ্ববর্তী কাউখালী, ইন্দুরকানী, রাজাপুর, কাঠালিয়া, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা এমন কি ঝালকাঠীর বিভিন্ন উপজেলার ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে।
তবে পিরোজপুর সদর উপজেলার পাঁচপাড়া ও চৈলশা হাট ঘুরেও দেখা গেছে এবছর ভারতীয় কোন গরু বাজারে নেই। দেশি গরুর আমদানি বেশি। অনেকে আবার আগামী হাটে কেনার জন্য দাম থেকে ফিরে গেছে। অনেক বলছে আগামী হাটে গরু দাম কমতে পারে। তবে অনেক ক্রেতাদের সাথে আলাপ কালে তারা জানান, এবছর গরুর দাম গত বছরের চেয়ে একটু বেশি। বেশিরভাগ ক্রেতাই ৭০, ৮০, ৯০, ১ লাখ ১০ হাজার টাকা এরকম দামে কিনেছেন। গরু মোটা তাজা করণের নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক্রেতারাও কৌশলে হাটেই ডোঙ্গায় করে খইল, ভূসি, কুরা পানিতে মিশিয়ে তা খাইয়ে দেখান ক্রেতাদের। হাটে দুই দিনের এ চিত্র দেখে মনে হয়েছে কোরবানির আগে গরুর হাটেই যেন তারা এক আনন্দের জানান দিচ্ছে।
হাট ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতা সমাগম বেশি দেখে বিক্রেতারা তাদের গরুর দাম একটু বেশি হেকে বসে আছে। পূর্বে বিদেশি বিশেষ করে ভারতীয় গরুর থাকলে এ বছর দেশি খামারীদের গরুই হাট ঘুরে দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ক্রেতারা জানান, দামও গতবছরের তুলনায় একটু বেশি। ছোট, বড় ও মাঝারি আকার ভেদে প্রতিটি গরুর মূল্য সর্বনিন্ম ৪৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার এবং ওপরে ৩ লাখ থেকে ৯ লাখ টাকার গরু রয়েছে। অন্যান্য বিক্রেতারা জানান, কোরবানির আগের দিন রাত পর্যন্ত কোরবানির পশু বিক্রয় হবে। তবে এবছর দেশি গরুই বেশি এবং দামও গত বছরের চেয়ে কমও রয়েছে।
এ পশুর হাট ঘুরে স্থানীয় খান এগ্রফাম, আনা হাটের সব চেয়ে বড় ৩৫০ কেজি ওজনের গরুটির দাম হাকা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। যা বিক্রেতা ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। এবং ১৭০ কেজি ওজনের অন্য গরুটির দাম হাকা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা। যা বিক্রেতারা ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম বললেও বিক্রেতা তাতে দেয়নি। এ ফার্মের মালিক মো. ফোরকান খান সৈকত তার সাথে আলাপককালে তিনি জানান, তার ফার্মে মোট ২৫ গরু আছে। এ গরু ৮ মাস ধরে লালন পালন করে বড় করতে প্রতি দিন খরচ পড়েছে ৮ হাজার টাকারও বেশি। অন্যএক বিক্রেতা জাহাঙ্গীর হাওলাদার বলেন, ছোট, বড় ও মাঝারি আকার ভেদে প্রতিটি গরুর মূল্য সর্বনিন্ম ২ লাখ ৭০ হাজার এবং ওপরে ২ লাখ ৮০ হাজার টাকার গরু রয়েছে এ ফার্মে। এবছর ১৬ টি গুরু নিয়ে এসেছেন, তা থেকে ৪ টি গুরু বিক্রি করেছে। যা গতবছর ১৬ থেকে ১৭ টি গরু বিক্রি হয়েছে।
খোজ নিয়ে জানাগেছে, পূর্ব ভান্ডারিয়া এলাকার জে. কে ডেইরিফার্মের সব চেয়ে বড় ১২ থেকে ১৫ মন ওজনের গরুটির দাম হাকা হয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এখন তিনি যদি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা পায় তাহলে বিক্রী করবেন। এ ফার্মের একজন শামিম আকন নামের একজনের সাথে আলাপককালে তিনি জানান, বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে ফার্মে এসে গরু কিনে নিয়ে যায় ত্রেতারা। তাই হাটগুলোতে নেওয়া হয় না। এ ফার্মের মালিক জাকির হোসেন নিজাম তার ফার্মে ছোট, বড় মিলিয়ে মোট ৭০ থেকে ৮০ টি গরু রয়েছে।
বাগেরহাট জেলার মোড়লগঞ্জ বাড়ইখালী এলাকার খমারী খালিদ হোসাইনের গরুই ছিল বড় আকারের যার মুল্য হাকা হয়েছে ৩ লাখ টাকা। তবে তিনি সেটি ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা হলে বিক্রী করবেন। চিংরাখালী গ্রামের বাসিন্দা ও মৎস্য ব্যবসায়ী জামাল মিয়া সর্বচ্চ ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় দুইটি গরু ক্রয় করেছেন। মাসুম শেখ নামের এক ক্রেতা মাঝারি সাইজের একটি দেশি গরু কিনেছেন ৫২ হাজার টাকায়। এছাড়াও পৌর এলাকার আবু সাঈদ নাইম একটি গরু কিনেছেন ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। এদিকে গরুর হাটে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ও জাল নোট ঠেকাতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে। গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য প্রাণী সম্পদ বিভাগের উদ্যোগে ২০ টি মেডিকেল টিমও রয়েছে। তারা জানান, ঈদুল আযহা উপলক্ষে ২০২৫ সালে কোরবানির জন্য প্রস্তত গবাদিপশুর সংখ্যা ৪৬ হাজার ৯৩৫ টি, চাহিদা ৪০ হাজার ২৫৭ টি, যা উদ্বৃত্ত ৬ হাজার ৬৭৮ টি। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ের মধ্যে ক্রেতাদের সাথে থাকা উঠতি বয়সী যুবকেরা উল্লাস প্রকাশ করার দৃশ্যও দেখাগেছে হাটে।
প্রবীণ গরু ব্যবসায়ীরা জানান, অন্যান্য হাটের চেয়ে এ হাটে অনেক দুর দুরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা আসে। রাজ্জাক মিয়া জানান, তার ফার্মে কোরবারিন জন্য ৯টি গরু হাটে নিয়ে এসেছে। তার মধ্যে বস চেয়ে বড়টির মুল্য হাকা হয়েছে ২ খাল ৬০ হাজার টাকা। এক ক্রেতা ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত বলেছে। গোয়ালের একটি গরু ১ লাখ ৮৫ টাকা দাম হাকা হয়েছে। এবং সেটি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দাম উঠলেও ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হবে বলে জানান বিক্রেতা সুমন মিয়া। এ হাটে উপজেলার প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন ব্যবসায়ী ছাড়াও দুর দুরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা গরু-ছাগল নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। এছাড়াও কৃষকেরাও বছরের এ একটি সিজনের জন্য আগে থেকেই দেশি গরুর পরিচর্যা করে বিক্রি করার জন্য নিয়ে আসে। দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত থাকায় ঠিকমত সময়ে আসতে না পাড়ায় কোরবানির গরু কিনতে সমস্যায় পড়তে পাড়ে সে জন্য কোরবানির আগের দিন রাত পর্যন্ত কোরবানির পশু বিক্রয় হবে। যাতে কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফিরে কোরবানির গরু কিনতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমস্যায় পড়তে না হয়। হাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে জালনোট সনাক্তকরন প্রক্রিয়া। ক্রেতা মো. স্বপন সাথে আলাপ কালে জানান, সে তার দুই ছেলেকে নিয়ে হাটে এসে ৭০ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছেন। এসময় দুরের ক্রেতাদের সাথে আলাপ কালে মাসুম, রত্তনসহ বেশ কয়েকজন জানান, হাটে একটি স্থানে জাল টাকা চেক করা, জেলা ও উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের উদ্যোগে গরুর রোগ নির্নয়ে ব্যনারসহ ক্যাম্প করা হয়েছে। হাটে পকেট মার রোধ সহ সর্বাত্মক ভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টহল দিচ্ছে।
জেলা, উপজেলা ও পৌর প্রশাসক জানান, আসন্ন কোরবারিন উপলক্ষে পশুর হাটে বিশেষ নিরাপত্তা এবং কোরবানির দিন পশু জবাইয়ের পর বর্জ অপসানের জন্য স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আর এগুলি মনিটরিং ও অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগব্যবস্থা গ্রহনের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।