জাহিদ আল হাসান, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামের উলিপুরে মুড়ি গুড় দিয়ে তৈরি সু-স্বাদু মোয়া (মলা) তৈরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছেন সাইফুল ইসলাম (৪০)। এখন তার দিনে আয় হচ্ছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। মোয়ার কারখানায় নিজের আত্মকর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার আরও ২০ থেকে ২৫ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সাইফুলের বানানো মোয়া তিন উপজেলার মানুষের চাহিদা পূরণ করছেন।
সাইফুল ইসলাম উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের তিস্তা পাড়ের গোড়াই পিয়ার এলাকার আব্দুল মজিত মিয়ার ছেলে। তার পরিবারে স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে থেতরাই বিএল উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে ও মেয়ে দলদলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাইফুল ইসলাম বাইসাইকেল ও রিকশার মেকানিকের কাজ করে সংসার চালাচ্ছিলেন। শারীরিক অসুস্থায় মেকানিকের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে শুরু হয় অভাব অনটন। অনেক ঋনের বোঝা হয়ে যায় মাথার উপর। উপায়ন্তর না পেয়ে তিন বছর আগে এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন বাড়িতে মোয়া তৈরির কাজ। শুরুর দিকে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে মোয়া তৈরি করে তা প্রথম দিকে ফেরি করে বাজারে বিক্রি করতেন। পর্যাক্রমে বাজারে মোয়ার চাহিদা বেশি থাকায় এখন ২০ থেকে ২৫ জন নারী ও পুরুষ মিলে মোয়া তৈরি করছেন। তা দু’টি অটোরিকশায় করে তিন উপজেলা উলিপুর, চিলমারী ও রাজার হাটের মোট ৪’শ থেকে ৫’শ টি দোকানে মোয়া বিক্রি করছেন। সাইফুল ইসলাম এখন ২ লক্ষ টাকার মুলধনে প্রতিদিন এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একটি বড় হাঁড়িতে জমাট বাঁধা গুড় তাপ দিয়ে তরল করা হচ্ছে। তরল গুড়ে মুড়ি মিশ্রিত করে তিনটি প্রক্রিযার মাধ্যমে নারীরা তৈরি করছেন মোয়া বা মলা। এসব মোয়া রাখা হচ্ছে পাশের একটি ঘরে। সেখানে আবার ১০টি করে মোয়া দিয়ে করা হচ্ছে একটি করে প্যাকেট। এক প্যাকেট মোয়ার পাইকারি দাম ৩০ টাকা। প্রতিদিন ৩ মণ মুড়ি ও ৪ মণ গুড় দিয়ে উৎপাদন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার মোয়া বা মলা। এগুলো বিক্রি করে শ্রমিক, পরিবহন ও অন্যন্য খরচ মিটিয়ে প্রতিদিন আয় করছেন এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। এখন বাজারে মোয়ার চাহিদা বেশি থাকায় খুবই ব্যস্থ সময় পার করছেন তিনি।
সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি গত তিন বছর ধরে মলা তৈরি করছি। আমার এখানে ২০ থেকে ২৫ জন নারী ও পুরুষ কাজ করছেন। তাদের ২শ টাকা পারিশ্রমিক দিচ্ছি। আমারও দিন গেলে এক হজার থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হচ্ছে। যা মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার ৪৫ হাজার টাকা। মোটামুটি সংসারটা এখন ভালো চলছে। ছেলে মেয়ের পরাশোনার খরচ যোগান দিতে পারছি। আগে তো খুব অভাব ছিল। টাকা পয়সা বেশি থাকলে আরও বড় পরিসরে কাজটি করতে পারতাম। আমার এখানে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মলা তৈরি হচ্ছে। এসব মলা আমি নিজেই পার্শ্ববর্তী তিনটি উপজেলায় বিক্রি করছি। এ মলা বিক্রি চলবে তিন মাস। বছরের বাকি মাস গুলোতে খাঁটি গাভীর দুধ দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা দই বাজারে বিক্রি করব। যা থেকে দিনে আয় হবে ৫’শ থেকে ৬’শ টাকা।
সাইফুল ইসলামের মোয়া তৈরির কারখানায় কাজ করতে আসা মর্জিনা (৪৫), আশা মণি (৩০), হামিদা (৪৭), মৌসুমি আক্তার (৩০) ও লাকী বেগম (৩২) সহ আরও অনেকে বলেন, আমরা অনেকে এখানে প্রতিদিন কাজ করি। দিন ২০০ টাকা পারিশ্রমিক পাই। স্বামীর ইনকাম ছাড়াও এখানকার আয়ে সংসারে যোগান দিচ্ছি। পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ারও খরচ চালাচ্ছি। তারা আরও বলেন, এভাবে বছরের প্রতিদিন কাজ থাকলে আমরা আরও অনেক লাভবান হতে পারতাম। সংসারের স্বচ্ছলতাও ফিরে আনতে পারতাম।
স্থানীয়দের মধ্যে ওমর ফারুক (২৮), শাহাবল মিয়া (৬০), রফিকুল ইসলাম (৫০) ও আবুল হোসেন সহ আরও অনেকে বলেন, সাইফুল ইসলাম তিন বছর আগে মেকানিকের কাজ করত। অসুস্থ হওয়ায় তার সংসারে অনেক অভাব অনাটন নেমে আসে। এখন মোয়া তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরে এসেছে। মোয়ার কারখানায় ২০ থেকে ২৫ জন নারী ও পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। তারা আরও বলেন, আমরাও সাইফুলের তৈরি করা মোয়া স্থানীয় দোকান থেকে কিনে নিয়ে খাই। অনেক সু-স্বাদু মোয়া বলে জানান তারা।
থেতরাই ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার বলেন, সাইফুল ইসলামের বাসা আমার এলাকাতেই। তিনি মেকানিকের কাজ করতেন। কয়েক বছর থেকে বাড়িতে মোয়া তৈরি করে বিক্রি করছেন। বাড়িতে মলা তৈরি করে ভালোই লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি তার এখানে ২০ থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। সরকারিভাবে তাকে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলে আমার মনে হয় আরও বড় পরিসরে মোয়া তৈরির কাজটি করতে পারতেন।