নাজমুল হোসেন, নিজস্ব প্রতিবেদক :
ভারতের বিহার ও ঝাড়খণ্ডে বন্যার জেরে ফারাক্কা ব্যারেজের ১’শ ৯টি গেট খুলে দিয়েছে ভারত। এতে একদিনে বাংলাদেশে ঢুকবে ১১ লাখ কিউসেক পানি। এই গেট খুলে দেওয়ায় দেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো প্লাবিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্যায় লক্ষ্মীপুরের প্রায় সবকটি এলাকা এখন পানির নিচে তলিয়ে আছে। রাস্তাঘাট, ফসলি মাঠ, বাড়ির উঠোন, রান্নাঘর- সবখানে এখন পানি আর পানি। কোথাও বুকসমান পানি, কোথাও কোমর পর্যন্ত পানি আবার কোথাও হাঁটু পর্যন্ত পানি। আবার দেখা যাচ্ছে কারো কারো ঘরের ভেতরেও পানি।
নদ-নদী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের পরিচালক এম আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ফারাক্কার গেট খুলে দেওয়ার খবরটি আমাদের জন্য বিপদজনক। এর ফলে দেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলাগুলো প্লাবিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্য দিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনস্থ সকল দপ্তর ও সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠান।
আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা, সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ত্বরিত মেরামতের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
বন্যা উপদ্রুত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)।
বন্যার পানিতে চারিদিক করছে থই থই। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে পানিতে তলিয়ে আছে নলকূপ, মানুষ সারতে পারাচ্ছে না যেতে শৌচাগার। কোনো কোনো মসজিদে আযান হলেও পড়া যাচ্ছে না নামাজ। হাঁটু সমান পানিও মসজিদের ভিতরে। এমন দৃশ্য মিলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কুশাখালী ইউনিয়নে।
আবার কোনো কোনো মসজিদে এখন আর নামাজ হয় না। তবে শুধু আযান হয়। আবার কোনো মসজিদে ব্যবস্থা নেই ওযুর পানির। বাধ্য হয়ে বন্যার অপরিষ্কার পানি দিয়েই ওযু করতে হয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দুর্গত গ্রামের বাসিন্দাদের। বন্যার পানির সঙ্গে শৌচাগার একাকার হয়ে আছে। সুপেয় পানির সংকট তো আছেই।
খাদ্যাভাবের পাশাপাশি দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা পানিবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগের শঙ্কায় রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বৃদ্ধ এবং শিশুরা।
অন্য দিকে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) তুলনায় গতকাল বুধবার (২৮ আগস্ট) পানি বেড়েছে অন্তত ১ ফুট।
লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে আছেন লাখ লাখ মানুষ। চলমান বন্যা পরিস্থিতির মধ্যে এতদিন যারা বাড়িঘর ছাড়তে চাননি, তাদের অনেকেই এখন উঠছেন আশ্রয়কেন্দ্রে ও স্বজনদের বাড়িতে। বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকেই।
তবে লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান জানিয়েছেন, প্রত্যেক মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার ৫টি উপজেলার ৫৮টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার প্রতিটি এলাকাই বিপর্যস্ত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে পানি। ১’শ ৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এসব মানুষের কেউ কেউ খাবার, ওষুধ, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা জানিয়েছেন। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পানিবাহিত নানা রোগ।
গত কয়েকদিনে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পৌর এলাকা ও সদর উপজেলার বন্যাকবলিত মান্দারী, দিঘলী, দত্তপাড়া, লাহারকান্দি, বাঙ্গাখাঁ, পার্বতীনগর, কুশাখালী, তেওয়ারীগঞ্জ, ভবানীগঞ্জের মিয়ার বেড়ি এবং কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা, রামগতি উপজেলার চর বাদাম, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নে গিয়ে মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেছে।
দিঘলী এলাকার একটি বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া নারী আমেনা বেগম বলেন, ‘ঘরে পানি উঠায় আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছি। কেন্দ্রটি একতলা ভবন।
দিঘলী এলাকার সুমন বলেন, মান্দারী থেকে দিঘলী সড়কের মাঝ বরাবর অংশে পানির উচ্চতা অনেক বেশি। ওয়াপদা খালপাড় সংলগ্ন এলাকাগুলোতে বুকসমান পানি। খালের ও পাড়ে লোকজন পুরোপুরি আটকা পড়ে আছেন। নৌকা না থাকায় সেসব এলাকায় কেউ যেতে পারছেন না। ত্রাণও পৌঁছায় না।
দিঘলী ইউনিয়নের আরেক বাসিন্দা জহির বলেন, বেশি পানি আমাদের এলাকাতে। এলাকার লোকজন চরম খাদ্য সংকটে আছেন। অনেকের রান্না করার মতো ব্যবস্থা নেই।
কুশাখালী ইউনিয়নের শান্তির হাটের ব্যবসায়ী জহির বলেন, মসজিদের ভেতরে পানি। তাই মুসুল্লিদের নামাজ পড়ার মতো অবস্থা নেই। মসজিদে শুধু আযান হয় তবে নামাজ হয় না।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, যে পরিমাণ পানির চাপ, সে হিসেবে পানি রেগুলেটর দিয়ে বের হতে পারছে না।