নিজস্ব প্রতিবেদক:
নতুন বছরকে বরণ এবং পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ১০টি ভাষাভাষি জনগণ প্রতিবছর উদযাপন করে থাকে তাদের প্রধান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব ‘বৈসাবি’। আগামীকাল (১২ এপ্রিল) থেকে শুরু হচ্ছে পাহাড়ি জনগণের এই প্রাণের উৎসব।
বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পার্বত্য এলাকার প্রতিটি প্রান্তে বিরাজ করছে উৎসবমুখর পরিবেশ। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের প্রতিটি জনপদে শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। ঘরে ঘরে চলছে আনন্দ-উল্লাস, সাজসজ্জা আর ঐতিহ্যবাহী নাচ-গানের আয়োজন।
বান্দরবানে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘ঘিলা খেলা’র মাধ্যমে শুরু হবে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। পুরো পাহাড় নতুন সাজে সেজে উঠেছে এ উপলক্ষে।
রাজধানীতেও বৈসাবি উদযাপন
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীতে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে বৈসাবি উৎসব উদযাপিত হবে। রাজধানীর বেইলি রোডের পার্বত্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু হয়ে রমনা পার্কের লেকে ফুল ভাসিয়ে নববর্ষকে বরণ করবেন পাহাড়ি ও বাঙালি মিলিত জনতা।
বৈসাবি – এক নাম, বহু উৎসব
‘বৈসাবি’ নামটি এসেছে তিনটি বড় জনগোষ্ঠীর উৎসবের আদ্যাক্ষর থেকে: চাকমাদের বিঝু, মারমাদের সাংগ্রাই, এবং ত্রিপুরাদের বৈসু। তবে এটি শুধু এই তিন সম্প্রদায়ের নয়; অন্যান্য নৃগোষ্ঠীগুলোও নিজ নিজ সংস্কৃতি অনুসারে ভিন্ন নামে এই উৎসব পালন করে।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমি, ম্রো, বম, লুসাই, পাংখোয়া, খিয়াংসহ আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব রীতিতে নববর্ষ ও চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করে।
চাকমা সম্প্রদায়ের বিঝু
১২ এপ্রিল ‘ফুলবিঝু’ দিয়ে শুরু হবে চাকমা সম্প্রদায়ের উৎসব। ভোরবেলায় ফুল সংগ্রহ করে তা দিয়ে পূজা, জলপ্রবাহে ভাসানো ও ঘর সাজানোর রীতি রয়েছে। ১৩ এপ্রিল পালিত হবে ‘মূল বিঝু’, যেদিন বুদ্ধমূর্তি স্নান করানো হয় এবং বয়স্কদের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেওয়া হয়। ১৪ এপ্রিল পালন করা হয় ‘গোজ্যেপোজ্যে দিন’ – যা মূলত বিশ্রামের সময়।
ত্রিপুরাদের বৈসু
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘বৈসু’ তিনদিনব্যাপী একটি উৎসব। হারি বৈসু, বৈসুমা ও বিসি কতাল নামক ধাপে ধাপে চলে উৎসব। এ সময় ফুল তোলা, ঘর সাজানো, প্রার্থনা, ও পবিত্র স্থানগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। বৈসাবির জনপ্রিয় খাবার ‘গণত্মক’ বা পাচন এবং বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী খাবার রান্না হয় এই সময়।
মারমাদের সাংগ্রাই
চার দিনব্যাপী সাংগ্রাই উৎসবের মূল আকর্ষণ ‘মৈত্রী পানিবর্ষণ’। পানি ছিটানোর খেলায় অংশ নেয় মারমা তরুণ-তরুণীরা। এই জলকেলির মাধ্যমে তারা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও মঙ্গল কামনা করে। বৌদ্ধ বিহারে প্রদীপ প্রজ্বালন ও প্রার্থনার মাধ্যমে উৎসবের আধ্যাত্মিক অংশটিও গুরুত্ব পায়।
তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু উৎসব
তঞ্চঙ্গ্যা জনগোষ্ঠী তিন দিনব্যাপী ‘বিষু’ উৎসব উদযাপন করে। সাংগু নদীতে কলাপাতায় করে পূজা, ঘিলা খেলা, ২০ থেকে ৩০ রকমের সবজির পাচন ও সাংস্কৃতিক আয়োজন চলে এসময়।
বৈসাবি ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগ
জনশ্রুতি রয়েছে, বৈসাবির শিকড় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া—এই অঞ্চলের নববর্ষ ‘সংক্রান’ উৎসবের সঙ্গে মিল রয়েছে বৈসাবির। মারমা সম্প্রদায় আরাকান থেকে সাংগ্রাই উৎসব সঙ্গে করে এনেছে বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত।
উপসংহার
বৈসাবি শুধু একটি উৎসব নয়—এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে ঐক্যের প্রতীক। এই উৎসবের মাধ্যমে পাহাড়ি-বাঙালি সবাই একত্রিত হন, সংস্কৃতির বন্ধনে জড়ান, এবং আনন্দ ভাগাভাগি করেন।