নাজমুল হোসেন, নিজস্ব প্রতিবেদক :
সাংবাদিকরা দুর্নীতি, দু:শাসন, অনিয়ম ও অসংগতি কাগজে-কলমে তুলে ধরেন, ধরছেন। দেশ জাতিকে এগিয়ে রাখেন। স্বপ্ন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেন। উন্নয়নকে তরান্বিত করেন। মৃত্যুভয় বা রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংবাদ পরিবেশন করা-ই হলো সাংবাদিকতা। তাইতো সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক।
বিবেকের দর্শনে দেশ, মানুষ ও মানবতাকে সত্যের সংমিশ্রমে তুলে ধরাই হলো প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ। অসাধ্যকে
সাধন করে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার নাম-ই হলো সাংবাদিকতা। অসংগতির বিরুদ্ধে কলম সৈনিকের সংগ্রাম অব্যাহত রাখাই হলো কলম সৈনিকের স্বার্থকতা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সাংবাদিক নামক অসাংবাদিকদের দৌরাত্ম থেমে নেই। যা মূল ধারার সাংবাদিকদের অস্তিত্বে আঘাত হানার হীন চেষ্টা।
অনেকই আছেন নিজের কর্তৃত্ব জাহির করতে নাম সর্বস্ব সাংবাদিক দিয়ে দল ভারী করছেন। এটা অপসাংবাদিকতার বহি:প্রকাশ। নিজিকে টিকিয়ে রাখতে হাইব্রীড সাংবাদিক বানানোর নামে যার তার হাতে কার্ড তুলে দিচ্ছেন। আসুন সচেতন হই। কাজের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য করে তুলি। ক্ষমা করবেন কারো সম্মানহানী করতে এই লিখা লিখছি না। সাংবাদিকতা করার অধিকার সবাই রাখেন।
তবে চিন্তা, চেতনায় ও মননে যে একজন লেখকমনা হয় তাকেই সাংবাদিকতা শিখিয়ে লেখার জগতে উন্মোচন করা উচিত। লিখতে হলে জানতে হবে। জানতে হলে শিখতে হবে। না শিখিয়ে হাতে কলম ধরিয়ে দিলে-ই সাংবাদিক হয় না। সাংবাদিক সৃষ্টি করা সহজ, যোগ্য সংবাদ পরিবেশক হিসেবে গড়ে তোলা কষ্টকর। যে কষ্ট করে না, শিখার চেষ্টা করে না, কপি করে হেডলাইনে ভুল করে। তাকে কী সাংবাদিক বলা যায়? তাইতো অনেকে সুযোগ নিয়ে আড়াল থেকে বলে ওরা ‘সাংবাদিক নয় সাংঘাতিক’। এই লজ্জা সকলের। লেখার ধ্বনিতে আলোক ধারায় নিপাত যাক অপসাংবাদিকতা। প্রকৃতরা সুনজর দিন। সাংবাদিকতা মানে তোষণপ্রীতি নয়। দালালী নয়। নয় কমিশন বাণিজ্য।
উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়- একজন সাংবাদিক জেলা - উপজেলা এমনকি গ্রামাঞ্চলেও তার ব্যাপক সুপরিচিতি। সবাই তাকে সাংবাদিক হিসেবেই জানেন, চিনেন। বলা যায় কিছুটা জাঁদরেল সাংবাদিকও বটে! রাস্তা ঘাটে তাকে কেউ সাংবাদিক ছাড়া ডাকেন না। প্রশাসন ও জনসাধারণের আয়োজিত সকল কর্মসূচিতেই তিনি আমন্ত্রিত হন, আমন্ত্রণ না পেলেও যান। তার আসল পরিচয় হলো- তিনি একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের চিত্র গ্রাহক। আছে নিউজ পোর্টালের নামে একটি ফেইসবুক পেইজ, আর নিজের নামে একটি ফেইসবুক আইডি।
কাঁধে একটি বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। তবে ব্যাগে সব সময় ক্যামেরা রাখলেও ক্যামেরা ব্যবহার কমই করেন তিনি। ছবি তোলার সময় মানুষকে বলেন- ক্যামেরায় চার্জ নেই, এভাবে সারা বছর ক্যামেরায় আর চার্জ দেয়া হয় না। এক্ষেত্রে তিনি স্মার্ট ফোনের উপর-ই নির্ভরশীল। তার সাংবাদিকতার দাপটে এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে সমীহ করে চলেন। কারণ কখন জানি কার বারোটা বাজিয়ে দেন।
এলাকার কিছু-কিছু ছোট ব্যবসায়ী তার কাছে ঠিকমতো পাওনা টাকা চাইতেও লজ্জা পান। লজ্জা নয় ঠিক ভয় পান। আর যে কোনো বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো কিছু কিনলে টাকা দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না। আর ব্যাবসায়ীরা এই টাকা চেয়ে ওই বড় সাংবাদিক কে লজ্জা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কারণ, কখন আবার তিনি ভেজাল ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে একখানা ছবি তুলে ভাইরাল করে দিবেন, তার ঠিক নেই! যাক, এসব উদাহরণ পড়ে ভাববেন না যে, সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা আজ চরম বিলুপ্তির পথে। বরং আমি শুধু বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকতার কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনা তুলে ধরলাম।
আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকগণ সমাজ পরিবর্তনের বড় অনুঘটক, নিয়ামক। গণমাধ্যম সকল অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে এক অসীম শক্তি। কারণ গণমাধ্যমের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, যেটা মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করতে পারে। মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে পারে। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশি গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশী গণমাধ্যম ও সাংবাদিকগণ বিশ্বব্যাপি জনমত গঠনে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মহান পেশার পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস দেখে আমার খুব কষ্টবোধ হয়। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি অপেশাদাররা সাংবাদিক পরিচয় বিক্রি করে সাংবাদিকতা পেশাকে কলঙ্কিত করে। আর অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শুধুমাত্র অনলাইন পোর্টাল অথবা ফেইসবুক পেইজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিউজ-ছবি কাভার করেই যদি মোটা টাকা পাওয়া ও সাংবাদিক বনে যাওয়া যায়, তাহলে কী দরকার ফিচার বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এর মতো জটিল সৃজনশিল কাজ করার?
আবার কেউ কেউ সাংবাদিক পেশার সাথে জড়িত না থেকেও বিভিন্ন নামে ফেইসবুক পেজ খুলে ‘অনলাইন টিভি’ বলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের চরিত্রহনন করছে। তারা সাংবাদিকতার নীতিমালা না জেনেই নিজেরদের ফেইসবুক পেইজে ‘অনলাইন টিভি’ নামে লোগো বানিয়ে বুম ব্যবহার করছেন। অথচ তারা কোথায়, কখন এবং কিভাবে বুম ব্যবহার করতে হয় তাও জানেন না।
এতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় গণমাধ্যম কর্মীদের।
সাংবাদিকতার এই পেশাকে আধুনিকায়ন করতে হবে, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনতে হবে।
সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমের তফাৎ বিবেচনায় সবাইকে স্বোচ্চার হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উপর ভরসা করে ভূইফোঁড় অনলাইন পোর্টালের সংবাদ নিয়ে সস্তা খেইড় খেলানীর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কঠোর নীতিমালার আওতায় আনতে হবে।
প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) সর্বোপরি তথ্য মন্ত্রণালয়কে আরো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার আধুনিক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে এবং পেশার মর্যাদা রক্ষায় নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনগত সুদৃড় ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে।
শেষ অংশে দিপ্ত কন্ঠে বলতে চাই অপসাংবাদিকতা বা হলুদ সাংবাদিকতাকে রুখতে না পারলে, ভবিষ্যতে এই পেশায় মেধাবী তরুণরা আসতে নিরুৎসাহিত হবেন।
আমাদের দেশের সাংবাদিকতার দিকপালদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস হারিয়ে যাবে।