সাইফুল ইসলাম জয় (হেলাল শেখ)ঃ দেশের বেশিরভাগ স্বর্ণের দোকানে লাইসেন্সবিহীন এসিড ব্যবহার ও বন্ধকী রেখে সুদের জমজমাট কারবারে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে এইসব অবৈধ ব্যবসা।
সোমবার (২৮ এপ্রিল ২০২৫ইং) জানা গছে, রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার সাভার আশুলিয়া, ধামরাইসহ বিভিন্ন এলাকায় স্বর্ণের দোকানে ও কারখানায় লাইসেন্সবিহীন এসিড ব্যবহার এবং কথিত বন্ধকীর নামে চড়া সুদের জমজমাট কারবারে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
রাজধানীর তাতীবাজারসহ বিভিন্নœ মার্কেটের দোকানে স্বর্ণ পরিক্ষা করতে যে, নাইট্রিক এসিড লাগে তার কোনো লাইসেন্স নেই দোকানদারদের। নিয়ম অনুযায়ী স্বর্ণ ক্রয়—বিক্রয় ও মেরামত করার সময় ভয়ংকর এসিড ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে এসিড অপব্যহার করছে এসিড সন্ত্রাসীরা। মাঝে মধ্যে মানুষের শরীরে এই এসিড নিক্ষেপ করার ঘটনাও ঘটছে, বাড়ছে এসিড সন্ত্রাস। দেশের প্রতিটি জেলা প্রশাসকের বিশেষ শাখা থেকে এসিডের লাইসেন্স নিতে হয় এবং সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে গোল্ড লেন্ডিং লাইসেন্স নিতে হয়। স্বর্ণ বন্ধকের বিনিময়ে সুদের ব্যবসা করতেও প্রয়োজন হয় মানি লোন্ডিং লাইসেন্স। কিন্তু এই দুইটি লাইসেন্সের কোনোটিই না নিয়ে বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের প্রায় ১২হাজার ৮শত (১২,৮০০) স্বর্ণের দোকান মালিক বা তার বেশি স্বর্ণের দোকানদার। এতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
বিশেষ করে যত্রতত্র এসিড ব্যবহার ও লাইসেন্স ছাড়া অ্যাসিড ক্রয়—বিক্রয় করা পুরোপুরি ভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও দেশের জেলা ও উপজেলা এবং থানা—ইউনিয়ন পর্যায়ে বেশিরভাগ স্বর্ণের দোকানের মালিকরা লাইসেন্সবিহীন এসিড ব্যবহার করছে। এর সাথে বন্ধকী কারবার জমজমাট ভাবে চালাচ্ছে এবং ভেজাল স্বর্ণের বিভিন্ন অলংকার তৈরি করে অবৈধ ভাবে ব্যবসা করছে অনেকেই। স্বর্ণের এক দোকানে ঢুকতেই দেখা গেলো, সোনার গয়নার উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য তরল জাতীয় কিছু ব্যবহার করছেন কারিগররা। জানতে চাই কী এটা? কারিগর বলেন, এটা সালফিউরিক এসিড। এই এসিড দোকানের এক কোণে ছোট কাঁচের শিশিতে রয়েছে। লাইসেন্স আছে তো? প্রশ্ন করলে দোকানদার ঘাবড়ে গেলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকান মালিক বলেন, আমরা অল্প পরিমাণে এসিড রেখে তা ব্যবহার করি।
জুয়েলার্স মালিক সমিতির নেতারা অনেকেই বলেন, এসিড ব্যবহার করলে লাইসেন্স প্রয়োজন—তা অনেকেই জানেন না। অনেকেই জানান, ২০—৩০টি সোনার দোকানের স্বর্ণালঙ্কার মিলে স্বর্ণ পরিস্কার করার জন্য একটি পালিশের দোকান দেয়, সেখানে স্বর্ণ পলিস হয়। স্বর্ণালঙ্কার পালিশের দোকানে অনেক বেশি এসিড ব্যবহার করা হয় বলে কারিগররা জানান। স্বর্ণ ভেজাল করার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা অনেকেই বলেন, আজ থেকে ১০—১২ বছর আগে সোনার ভেতরে নিয়মের চেয়ে বেশি ভেজাল দেওয়া হতো, বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বর্ণ পরিক্ষা করা হয়। বর্তমানে স্বর্ণের মধ্যে ভেজাল দেওয়ার সুযোগ নেই বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। তবে বর্তমানে স্বর্ণের দাম উঠানামা করছে এক লাখ ৭২ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা বিক্রি করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, স্বর্ণের ব্যবসা করতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন—১৯৫৬ প্রনীত ১৯৮১ এর বিধান অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের ব্যবসা—বাণিজ্য শাখা কাপড়, রড,সিমেন্ট, সুতা, বেবিফুট, সিগারেট বন্টনকারি, জুয়েলারি গোল্ড ডিলিং লাইসেন্স নিতে হয়। সূত্র জানায়, ৩০% ব্যবসায়ী লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন। ৭০% ব্যবসায়ীরা লাইসেন্সবিহীন ভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি—বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিং ও উদ্যোগের অভাবে ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ পাচ্ছেন। এতে দেশের প্রায় ১২ হাজার ব্যবসায়ী সরকারি ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টর। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়েছে কে বেশি লাভবান হবেন, ১০—১২ বছর আগে যাদের কিছুই ছিলো না, তারাও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক, একদিকে চোরাকারবারী আর অন্যদিকে সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা শত শত কোটি টাকার মালিক বুনে গেছে।
জেলা প্রশাসনের অফিসের তথ্যমতে, স্বর্ণ ব্যবসা করতে সরকার নির্ধারিত শুধু গোল্ড ডিলিং লাইসেন্স ফি ৫হাজার টাকাসহ ১৫% ভ্যাট এবং লাইসেন্স নবায়ন ফি আড়াই হাজার টাকাসহ ১৫% ভ্যাট। সারাদেশে প্রতিটি জেলায় ২০০—২৫০টি স্বর্ণের দোকান রয়েছে, তা হিসেব করে কত হাজার সোনার দোকান ও কারখানা আছে তার হিসাব নাই। কিছু এলাকায় তারচেয়ে বেশি বা কম দোকান রয়েছে, যাদের কোনো লাইসেন্স নেই। সেই হিসাবে সারা দেশে প্রায় ১২ হাজারের বেশি স্বর্ণের দোকানের লাইসেন্স নেই। এই হিসাবে কোটি কোটি টাকার ভ্যাট ও আয়কর ফাঁকি দিচ্ছে জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম জয় একজন বলেন, ৯৬ রতি সমান ১৬ আনায় এক ভরি সোনার দাম বৃদ্ধির কারণে সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার স্বর্ণ শিল্পী শ্রমিক বেকার হতে চলেছে। সারা দেশে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে তাদের কাছে লাইসেন্স গ্রহণের নোটিশ প্রেরণ করা জরুরি। নোটিশ প্রাপ্তি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লাইসেন্স গ্রহণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সাথে আলোচনা করলে তারা বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও অত্যাবশ্যকীয় পন্য ব্যবসায়ীদের লিষ্ট করে তাদেরকে নির্ধারিত সময় দেওয়ার মাধ্যমে লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। লাইসেন্স না করলে সকল প্রতিষ্ঠানের যে সকল মালিক লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং এসিড ক্রয়—বিক্রয় ও ব্যবহার করছে, তাদের লাইসেন্স না থাকার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তারা জানান। এ বিষয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। পর্ব—১।