বিশেষ প্রতিনিধি-হেলাল শেখঃঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় বেশিরভাগ বাসা বাড়িতে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি-গ্যাস লাইনে অগ্নিকান্ড ও বিস্ফোরণে দেড় বছরের শিশুর মৃত্যুসহ বেশকিছু লোক আহত হয়েছেন। এ এলাকায় অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে গ্যাস লাইন থেকে। অন্যদিকে অবৈধ সংযোগ দেওয়ার কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, কিছুদিন আগে আশুলিয়ার কাঠগড়ায় তিতাস গ্যাসের লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে হাজী আগবরের একতলা ভবন ধসে ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া মাগুড়ার নাজমুল হুদার ছেলে অবুঝ শিশু তাছিম (২), নিহত হয়েছে।

এ সময়ে নারী ও শিশুসহ আরও ৪ জন ব্যক্তি আহতের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে ভাদাইলসহ আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে অনেক লোকজন আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানান।জানা গেছে, আশুলিয়ার মোঃ সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, মোঃ জলিল, শাহিন পালোয়ানসহ ৬-৭ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তিতাস গ্যাসের লাইন থেকে অবৈধভাবে সংযোগ দিয়েছেন। এক একটি বাড়ি মালিকের কাছ থেকে ৫০-৮০ হাজার টাকা নিয়ে প্রথম সংযোগ দিয়ে শুরু হয় চোর পুলিশের খেলা, এরপর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর আবার ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দালালদেরকে প্রতি মাসে দিতে হয়। পুরো এলাকা থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা কালেকশন করা হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
এই চক্রের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হলেও গ্রেফতারের নামে কিছু অসাধু পুলিশ অফিসার টাকার বিনিময়ে আসামী আটক করে গাড়িতে ৩-৪ ঘন্টা রেখে টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া আশুলিয়ার কাঠগড়া একই স্থানে ৭বার গ্যাস সংযোগ দেয়া হয় ওই সংযোগ আবার বিচ্ছিন্ন করা বিষয়টি নাটকীয়, এ যেন চোর পুলিশের খেলা। জানা গেছে, যেকোনো এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটলে ওই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক (দিপু) তিনি সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত করে দেখা হবে, অপরাধী সে যেই হোক না কেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার নয়ারহাট, পল্লী বিদ্যুৎ, বাইপাইল, বগাবাড়ি, ইউনিক, শিমুলতলা, জামগড়া, ভাদাইল, পাবনারটেক, ইউসুফ মার্কেট, নরসিংহপুর, ঘোষবাগ, জিরাবো, কাঠগড়া, মানিকগঞ্জ পাড়া, মীর বাড়িসহ বিভিন্ন বাসা বাড়িতে অবৈধ সংযোগের ছড়াছড়ি, এ যেন দেখার কেউ নেই। এসব সংযোগ পেতে দালাল চক্রকে লাখ লাখ টাকা দিতে হয়েছে বলে গ্রাহকরা জানান। তারা বলেন, মাঝে মধ্যে তিতাস কোম্পানির কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়ে কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও আবার নিজেরা নিম্নানের পাইব দিয়ে সংযোগ চালু করেন বেশিরভাগ বাড়ির মালিক। অনেকেই বলেন, এই সংযোগের অর্থ অনেকেই ভাগ পেয়ে থাকেন, এর কারণে এলাকাবাসী ওই চক্রের দালালদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারেনা। কেউ মুখ খুলতে চায় না। অনেকেই বিভিন্ন উপর মহলের লোকদের পরিচয় দিয়ে তিতাস গ্যাসের এসব সংযোগ দিচ্ছেন। অনিয়ম দুর্নীতি করছেন সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।বিশেষ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রায় ২২টি খাতে দুর্নীতি হয় উল্লেখ করে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
শিল্পাঞ্চলের যেখানে-সেখানে তিতাস গ্যাসের অবৈধ সংযোগ ব্যবহার করায় সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অনুসন্ধানী এবং পর্যবেক্ষণমূলক এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন দুদকের কমিশনার ড. মোজ্জামেল হক খান।

“প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দুদকের এই কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, দুদকের এই প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে”। দুদক কমিশনার বলেন, ২০১৭ সাল থেকে দুর্নীতির জনশ্রæতি রয়েছে এমন ২৫টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের আইন, বিধি, পরিচালনা পদ্ধতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ অপচয়ের দিকগুলো পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করছে কমিশন। এসব প্রতিষ্ঠানের জনসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সফলতা ও সীমাবদ্ধতা, আইনি জটিলতা, সেবা গ্রহীতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির কারণগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করে তা বন্ধের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৫টি প্রতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি টিমের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কমিশনার আরও বলেন, এসব টিম অনুসন্ধান চালিয়ে দুর্নীতির উৎস দেখতে সঠিকভাবে তদন্ত করতে হবে। তিতাস গ্যাস সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমটি তাদের অনুসনন্ধানে তিতাসের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমান কর্মকর্তা এবং এ বিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে, পরে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেটা পর্যালোচনাও করেন। এ ছাড়া তিতাসের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনসহ ভুক্তভোগী সেবা গ্রহীতাদের বক্তব্য ও পর্যালোচনা করেন টিম। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন, নিরীক্ষা ও অডিট প্রতিবেদনও পর্যালোচনার আওতায় আনে তারা। সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে আমাদের এই টিম তিতাসের দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্র দেখতে হবে। এবং তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করেন। মোজ্জামেল হক বলেন, তিতাসের এই প্রতিবেদনে ২২টি সম্ভাব্য দুর্নীতির উৎস প্রমান করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-অবৈধ সংযোগ, নতুন সংযোগ অনীহা এবং অবৈধ সংযোগ বৈধ না করা, অবৈধ লাইন পুনঃসংযোগ, অবৈধ সংযোগ বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ না নেওয়া, অদৃশ্য হস্তক্ষেপে অবৈধ সংযোগ দেয়া, গ্যাস সংযোগে নির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ না করা, বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহককে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া, মিটার টেম্পারিং, অনুমোদনের অতিরিক্ত বয়লার ও জেনারেটরে গ্যাস সংযোগ, মিটার বাইপাস করে সংযোগ দেওয়া সংক্রান্ত দুর্নীতি, এস্টিমেশনের চেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করেও সিস্টেম লস দেখানো, ইচ্ছে করে ইভিসি (ইলেকট্রিনিক ভলিউম কারেক্টর) না বসানো। বিশেষ করে এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশনের প্রতিবেদনে ১২ দফা সুপারিশ উল্লেখ করেছেটিম। কমিশনের এই প্রতিবেদন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হলে দুর্নীতি প্রতিরোধ সহজ হবে। এভাবে দুর্নীতি হওয়ার আগেই, তা প্রতিরোধ করা গেলে, মামলা করার প্রয়োজন পড়বে না। তিনি আরও বলেন, সরকার যে কোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের যে ঘোষণা দিয়েছে, কমিশন সে ঘোষণা বাস্তবায়নে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক কার্যক্রম সফল করছে। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবেই এ প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে। এসময় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দুদকের এই কার্যক্রমের প্রশংসা করে বলেন, দুদকের এই প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে দেখে যথাযত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। তিনি জানান, এই মন্ত্রণালয়ে তা কার্যকরভাবে অনুসরণ করা হবে। তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তার অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।এ ব্যাপারে সাভার তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (জোবিঅ) প্রকৌশলী আবু সাদাৎ মোহাম্মদ সায়েম জানান, সাভার আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় প্রতিদিন অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে, অবৈধ সংযোগ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় ১৫টি মামলা করা হয়েছে এবং সাভার থানায়ও ৪টি মামলা করা হয়েছে। এসব এক একটি মামলায় আসামী করা হয়েছে ৪৭-৫০ জনের মতো, তিনি দাবি করেন যে, এই ১৯টি মামলায় ৯০০ জনের মতো আসামী করা হয়েছে, এদের মধ্যে মাত্র ২জন আসামীকে আটক করা হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, আসল চোর কারা? একই স্থানে বার বার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে তিনি জানান