1. admin@sokalerbangla.com : সকালের বাংলা :
বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ন
শিরবাম:
শিক্ষার্থীদের চোখে আগামীর বাংলাদেশ ও ছাত্র রাজনীতি কেমন হবে সিরাজগঞ্জ জেলা পর্যায়ে শিশু -কিশোর ইসলামিক সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ রাণীশংকৈলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেদের মাঝে বিনামূল্যে  বীজ ও সার বিতরণ নওগাঁয় ধান ক্ষেতে পড়েছিল হাড় ও নাড়ি-ভুড়ি; মিলল পরীক্ষার্থীর অর্ধগলিত মরদেহ আওয়ামী লীগের নেতা সাঈদ পারভেজ আটক চিহ্নিত এক রাজনৈতিক দল শহীদদের সাথে বেইমানি করে ক্ষমতায় যেতে চায়: ফয়জুল করীম টেকসই কৃষি উন্নয়নে তারেক রহমানের ভাবনা তারেক রহমান একদিকে কৃষকদের উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন হিলি বাজার পরিদর্শনে দিনাজপুর জেলা প্রশাসক। আমদানি রফতানিকারকদের সাথে মতবিনিময়। নওগাঁ জেলা ও সার বীজ মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত

ভালো খাবার রান্না করবেন না নাঈমার মা, পঙ্গুতের জীবন শুভর। শহিদ সোহাগ মিয়া

Reporter Name
  • Update Time : বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪
  • ৩৬ Time View

দৈনিক সকালের বাংলা ডেস্কঃ  গ্রামের বাড়িতে ছোট্ট ডোবার পাড়ে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন শহিদ সোহাগ মিয়া। তাঁর কবরের পাশেই উড়ছে লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে হাত তুলে মোনাজাতে কাঁদছেন বাবা মো. আবুল কালাম। দুই চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছে তাঁর। এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্য চোখে পড়ে জামালগঞ্জ উপজেলার গুলামিপুর গ্রামে গিয়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে শরীক হওয়া শহিদ সোহাগ মিয়া’র বাবার কান্না কিছুতেই থামছে না জানালেন গ্রামবাসী।

স্বৈরাচারী সরকারের পতনের খবরে গত ৫ আগস্ট প্রতিটি পাড়া মহল্লায় বের হয় বিজয় মিছিল। দেশজুড়ে সেই মিছিলে শরীক হন কোটি জনতা। বিজয়ের সেই সন্ধিক্ষণে ঢাকার রাজপথের মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের গুলামিপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. সোহাগ মিয়া (২৩) ও শুভ মিয়া (২২) নামের দুই সহোদর। কে জানতো সেটাই হবে দুই ভাইয়ের একসঙ্গে শেষ বিজয় উল্লাস। মিছিলে গুলি চালায় নির্দয় পুলিশ, গুলিবিদ্ধ হন দুইভাই। গুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে যায় বড় ভাইয়ের।

রাজধানীর বাড্ডা এলাকার মিছিলে যুক্ত হয়েছিলেন তারা। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে আসলে পুলিশ গুলি চালায়। সেই মিছিলে দুই ভাই গুলিবিদ্ধ হলে প্রাণ যায় বড় ভাই সোহাগ মিয়ার। পর দিন মঙ্গলবার ৬ আগস্ট বেলা ২ টায় জামালগঞ্জ উপজেলার হেলিপ্যাড মাঠে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতাকর্মী ও সমর্থকবৃন্দসহ হাজারো ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে নিহতের নামাজে জানাযা সম্পন্ন হয়। এরপর তাঁর গ্রামের বাড়ির পঞ্চায়েতি কবর স্থানে শহিদ সোহাগের দাফন করা হয়।

ছয় ছেলেমেয়ের পিতা দিনমজুর আবুল কালাম। অসহায় এই পিতা রিকশা চালাতেন জামালগঞ্জ উপজেলা সদরে। পরে বার্ধক্যে উপনীত হলে রিকশা ছেড়ে জমি বর্গা চাষ শুরু করেন। জমি চাষের ফাঁকে দিনমজুরি করছেন। কখনও বেকার থাকতেন না তিনি। মা রোকেয়া বেগম ছেলেদের সাথে ঢাকায় থাকতেন। তিনি চাঁদপুরের মেয়ে। অভাবের কারণে সন্তানরা পড়াশোনা করতে পারেনি। সন্তানদের মধ্যে সোহাগ তৃতীয়। ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালি ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। গোলামীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন সোহাগ।

মা-বাবার পরিবারে ৫ ভাই ও ১ বোন তারা। এর মধ্যে শহিদ সোহাগ ছিলেন  ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় ও পরিবারের তৃতীয় সন্তান।

এদিকে তৃতীয় ভাই শুভ গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়ে গেছেন। বড় ভাই বিল্লাল মিয়া, চতুর্থ ভাই যুবায়ের মিয়া ও পঞ্চম ভাই আজিম মিয়া এই তিন ভাই রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। শুভ বিয়ে করেন ঢাকায়। তার একমাত্র কন্যা নুসরাত আক্তার সোহাগীর বয়স ১ মাস ২০ দিন। বড় বোন আফিয়া বেগমের বিয়ে হয় রংপুরে। তার স্বামী আনসার বাহিনীতে চাকরি করেন।

করোনা মহামারির সময়কালে বিদেশ যাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রামের বাড়ি হতে বের হন সোহাগ। কিন্তু প্রতারক দালালের খপ্পরে পড়ে আর বিদেশ যাওয়া হয়নি তার। খবর পান দালাল ব্যাটা সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছেন। পাওনা টাকা উদ্ধারের লক্ষ্যে তিনিও চলে যান পাথারিয়া গ্রামে।  সেখানে পাথারিয়া নিবাসী সুন্দর মিয়ার বাড়িতে দেড় বছর অবস্থান করে একাধারে পাওনা টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেন অন্যদিকে পাথারিয়া সেতুর নির্মাণ কাজে শ্রমিক মজুরের দায়িত্ব পালন করেন। সোহাগের পিতা ২০১৯ সালে সোহাগকে প্রবাসে পাঠাতে ঋণ ও জায়গা জমি বিক্রি করে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন দালালের হাতে। কিন্তু দালাল কর্তৃক প্রতারিত হন আবুল কালাম। এই ঋণের টাকাই তারা এখনও শোধ করতে পারেননি।

ঋণের টাকার জন্য এলাকা ছাড়েন একসঙ্গে পাঁচ ভাই। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার হোসেন মার্কেট বউ বাজারে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে একটি টিনশেড বিল্ডিং-এ থাকতেন তারা। তিন ভাই নিয়মিত রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন।

অন্যদিকে সোহাগ, হোসেন মার্কেটের আশা ফ্যাক্টরিতে দেড় বছর কাজ করেন। সেখানে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৯ হাজার টাকা। কিন্তু ফ্যাক্টরিতে অভারটাইম কাজ করে আরো ৫ হাজার টাকা রোজগার করতেন সোহাগ।

গত পাঁচ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিল দেখে টগবগে এই তরুণরা নিজেদের আটকাতে পারেননি। যোগ দেন মিছিলে। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে আসলেই পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। এখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন সোহাগ। শুভ’র শরীরেও গুলি লাগে। তিনি এখন পঙ্গু।

শুভ বলেন, ‘সবার সঙ্গে আমরাও মিছিলে যোগ দেই। মিছিলটি বাড্ডা থানার সামনে গেলে পুলিশ গুলি করে। সেখানে আমার শরীরেও গুলি লাগে। পরে অন্যরা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার ভাইয়ের শরীরেও গুলি লাগে। সে ওখানেই মারা যায়। তিনি বলেন, হাসপাতালে সার্মথ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করিয়ে বাড়িতে চলে আসি। এখনও পায়ে দু’টি গুলি রয়ে গেছে। আগের মতো কাজ করতে পারি না। পা ব্যথা করে। টাকা পয়সার অভাবে অপারেশন করে গুলি বের করতে পারছি না।’

শুভ মিয়া’র পায়ে এখনো ছররা গুলি আটকে আছে। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না বলে জানালেন পরিবারের সদস্যরা।

শহিদ সোহাগের বড় ভাই মো. বিল্লাল মিয়া বলেন, ২০১৯ সালে ভাইকে বিদেশ পাঠানোর জন্য জায়গা জমি, গরু বিক্রি করেছি তবুও টাকা মেলাতে না পারায় মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দালালের হাতে তুলে দিয়েছি। সেই দালাল আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এক টাকাও ফেরত পাইনি। পরে ঋণের চাপে আমরা পাঁচ ভাই এলাকা ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে কাজ শুরু করি।

ছেলে হারানোর শোকে কাতর মা রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আমার ছেলে ঘরে এসে আমার মন খারাপ দেখলে জড়িয়ে ধরতো। মন ভালো করে দিতো সে। আজ সে নেই।’ ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দাবি করেন তিনি।

সোহাগের বাবা আবুল কালাম বলেন, হার্টে সমস্যার কারণে চার বছর ধরে কাজ করতে পারি না। ঢাকা থেকে ছেলেরা কাজ করে টাকা পাঠায়। সে টাকায় সংসার চলে। ছেলে মারা যাওয়ার পর সবাই বাড়িতে এসেছিল, এখনো আছে। ধার-দেনা করে সংসার চলছে বলে জানান তিনি।

এক শতক জায়গায় একটি ভাঙাচোরা ঘরে বসবাস শহিদ সোহাগের পরিবারের। জং ধরা টিন, বাঁশের এই ঘরটির চালা ফুটো। বৃষ্টি হলে ঘরে থাকা দায়। প্রতিবেশীদের দাবি, গুলিবিদ্ধ ছেলে শুভ মিয়ার উন্নত চিকিৎসা ও পরিবারের জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করবে সরকার।

জামালগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ বলেন, পাঁচ ছেলের মধ্যে দুই ছেলেই ছাত্র জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। সেখানে এক ছেলে মারা গেছে, আরেকজন আহত অবস্থায় আছে। তার পায়ে এখনও গুলি রয়ে গেছে। আমরা চাই গুলিবিদ্ধ ছেলের উন্নত চিকিৎসা সরকার করবে। এছাড়াও তার পরিবারের জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থা করার দাবি জানাই সরকারের কাছে।

অপর এক খবরে জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ঢাকায় নিহত শ্রমিক সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার গোলামীপুর গ্রামের শহিদ সোহাগ মিয়ার পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এছাড়া জামালগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোলামীপুর গ্রামে নিহত সোহাগ মিয়ার পরিবারের খোঁজ-খবর নিতে আসেন বাংলাদেশ জমায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলার নেতৃবৃন্দ।

বক্তারা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সকলকেই বীর যোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, আগস্ট মাসের ৫ তারিখে আল্লাহর পক্ষ থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের ছাত্র-জনতার ঐক্যে জুলুমবাজ আওয়ামী লীগের সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। পরে নিহতের পরিবারের হাতে দুই লাখ টাকার আর্থিক অনুদান তুলে দেন নেতৃবৃন্দ।

এদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ব্যাপক হারে মেয়েদের অংশগ্রহণ। চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথম যে মেয়েটি শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিল তার নাম নাঈমা সুলতানা। বয়স ১৫ বছর।

রংপুরে ১৬ জুলাই আবু সাঈদকে হত্যার মধ্যদিয়ে আন্দোলন নতুন বাঁক নেয়। আন্দোলন যখন তুঙ্গে পুলিশও তখন তীব্র মারমুখী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ছত্রছায়ায় কেবল পুলিশই নয় তৎকালীন সরকার দলীয় ক্যাডাররাও তাদের যৌথ হামলা জোরদার করে। এসবের ধারাবাহিকতায় ১৯ জুলাই, শুক্রবার পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেদিন এই নারী বীর নাঈমা সুলতানাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শাহাদাত বরণ করেন।

শহিদের মায়ের সাথে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রতিনিধির সাথে কথা হয়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে বাংলাদেশ মেডিকেলের ঠিক পেছনের মেইন রাস্তার ওপর নাঈমাদের ভাড়া বাসা। গোলাম মোস্তফা (৪৪) ও আইনুন নাহার (৩০) দম্পতির মেজ সন্তান ছিলেন তিনি। ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী। এখনো বাসার ড্রইং রুম ও তার রুমে বিজ্ঞান বিভাগের বই ও গাইডগুলো থরে থরে সাজানো। পুরো ঘরের চারদিকে নাঈমার স্মৃতি। সবই আছে, শুধু নেই শহীদ নাঈমা সুলতানা।

 

তাঁর মা বাসসকে বলেন, ‘আমার মেয়েটা খুব মেধাবী ছিল। আমাদের বাড়ি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর থানার আমুয়াকান্দি গ্রামে। সেখানে প্রথম শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত সবগুলো ক্লাসে সে প্রথম স্থান অর্জন করে। তারপর শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদের ভালো লেখাপড়ার জন্য আমরা এই উত্তরায় এসে বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করি। ওর বাবা গ্রামে একটা ফার্মেসি চালায়। সেই ফার্মেসীর আয় দিয়ে তিনটা ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, কি যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারবো না। তারপরও ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যবসার জন্য ওর বাবা গ্রামে থাকে আর আমি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ঢাকায় একা থাকি। ও শুধু বলতো, মা আমি আন্দোলনে যাবো, আমি মিছিলে যাবো। আমার স্কুল থেকে মিছিলে গেলে আমি যাবো, তুমি আমাকে না করতে পারবা না। শুধু নিজেই মিছিলে যেত না, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতো। বন্ধুদেরকে বলতো, তোরাও মিছিলে আয়। সে চিত্র এঁকে এঁকে বন্ধুদেরকে নিয়ে আন্দোলনে শরিক হয়েছিল।

শহিদ নাঈমা সুলতানার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। স্বপ্ন পূরণে চাঁদপুর থেকে ঢাকায় এসে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন উত্তরাস্থ মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে। মৃত্যুর সময় এই স্কুলের দশম শ্রেণি বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি খুব ভালো ছবি আঁকতেন। সে যোগ্যতা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন এবারের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। উত্তরার অনেক দেয়ালে এখনো সে গ্রাফিতিগুলো জ্বলজ্বল করছে, যা এখন শুধুই স্মৃতি। এ শহিদের স্মৃতির প্রতি সম্মান রেখে উত্তরার ছাত্র-জনতা সোনারগাঁ জনপথের একদম পশ্চিম মাথা খালপাড়ের নামকরণ করেন ‘নাঈমা চত্বর’।

এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় শহিদ নাইমা সুলতানাদের ফ্ল্যাটের উপর তলার প্রতিবেশী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের সাথে। যিনি শহিদ নাঈমার নিথর দেহ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, সেদিন ছিল শুক্রবার। উত্তরার ছাত্র-জনতা এর আগের দিন অর্থাৎ ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবারের গণহত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। উল্লেখ্য ১৮ই জুলাই উত্তরায় ৩০ জনের বেশি শাহাদাত বরণ করেন। শহিদদের সঠিক সংখ্যা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। কারণ সেদিন অনেকগুলো লাশ পুলিশ গুম করেছিল। সেদিন উত্তরার উপর দিয়ে যেন রোজ কেয়ামত নেমে এসেছিল। এ নারকীয় গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী উত্তরার ছাত্র-জনতা তাই পরদিন শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে তীব্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা।

এ গণমাধ্যম কর্মী আরও বলেন, সেদিন সেই শুক্রবারের আন্দোলনের একটি বিশেষ দিক ছিল বেশিরভাগ ছাত্রদের সাথে তাদের অভিভাবকরা যোগ দিয়েছিলেন। অভিভাবকদের কথা ছিল, ‘গতকাল আমাদের সন্তানদেরকে কেন গুলি করা হলো? ছোট ছোট মাসুম বাচ্চা, এসএসসি/ এইচ এস সি পর্যায়ে পড়ে। ওরা তো কোন অন্যায় করেনি, অপরাধ করেনি। ওরা ওদের বৈধ অধিকারের কথাই শুধু বলেছে।ওদেরকে এভাবে গুলি করে মেরে ফেললে আমরা কাদের নিয়ে বাঁচবো। আমাদেরকেও মেরে ফেলেন।’

ওইদিন শুক্রবার দুপুর বারোটা থেকেই শিক্ষার্থীদের সাথে চলে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। শহিদ নাঈমা সুলতানা ও তার সহযোদ্ধারা বাংলাদেশ মেডিকেলের সামনের সোনারগাঁ জনপথে অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে বিকেলের দিকে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের ধাওয়ার মুখে টিকতে না পেরে বাংলাদেশ মেডিকেলের পেছনে তাদের বাসার সামনে চলে আসেন। আর পুলিশ অবস্থান নেয় বাংলাদেশ মেডিকেলের পাশের গলির মুখটাতে, একেবারে মুখোমুখি। এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। আশপাশের বিল্ডিং থেকে সাধারণ মানুষ যেগুলো ধারণ করেছে, সেগুলোতে খুনিদের চেহারা একদম দৃশ্যমান।

শহিদ নাঈমা সুলতানা তখন তাদের বাসায় ওঠেন। বাসায় উঠে বারান্দা থেকে ২০০ গজ দূরে পুলিশের অবস্থান দেখার চেষ্টা করেন। ঠিক তখনই মুহুর্মুহু গুলিতে অসংখ্য শিক্ষার্থী লুটিয়ে পড়েন আর শহিদ নাঈমা সুলতানার ঠিক মাথার মধ্যে গুলি লাগে বেশ কয়েকটা। সাথে সাথেই তিনি বারান্দাতে লুটিয়ে পড়েন। বাসার লোকজন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তখন তাদের ডাক-চিৎকারে আশপাশের ফ্ল্যাটের মানুষজন দৌড়ে আসেন। আশেপাশের বাসিন্দারা সব দেখতে পাচ্ছিলেন। অনেকেই তখন এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন, যা এখন এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য অনেক বড় একটা দলিল।

কথা হয় শহিদের বড় বোন তাসপিয়া সুলতানার সাথে। যিনি মাইলস্টোন কলেজের একাদশ শ্রেণী বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। দুই বোন ছিলেন পিঠাপিঠি।

তিনি বলেন, ‘আমরা দুইজন একসাথেই স্কুলে যেতাম এবং লেখাপড়া করতাম। এ বছর আমি এসএসসি পাস করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়াতে ওর সাথে আমার ক্লাসের সময়টা ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারপরও আমাদের খুনসুটি লেগেই থাকতো। আজকে আমার একমাত্র আদরের ছোট বোনটি নেই। কাকে নিয়ে আমরা বেঁচে থাকব? আমাদের জীবনে এখন শুধুই শূন্যতা।’

একমাত্র ছোট ভাই আব্দুর রহমান। সেও পড়ে একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীতে। সে আমাদের সাথে কোন কথাই বললো না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো।

মামলার বিষয়ে শহিদের মাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আমাদের পরিবারের অভিভাবক নেই বললেই চলে। কে মামলা করবে, কে মামলা চালাবে? এ জন্য আমরা মামলা করিনি। আমরা আল্লাহর দরবারে মামলা করেছি, তিনি এর বিচার করবেন। ওর বাবা গ্রামে থাকে এবং অসুস্থ। আদরের মেয়েকে হারিয়ে সে আরো অসুস্থ হয়ে গেছে। ঢাকায় এসে থাকতেই পারে না। ওর জিনিসপত্র দেখলে ডুকরে কেঁদে ওঠে। তাই আমিও আর তাকে ঢাকায় থাকার জন্য চাপ দেই না। একটা সন্তানকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কত কষ্ট করে আমরা বড় করেছি। সেই সন্তানের লাশ মায়ের সামনে। সন্তানের লাশ বাবার কাছে কত যে কঠিন, তা তো বলে বোঝাতে পারবো না। গত আড়াই মাস যাবত ভালো কিছু রান্না করতে পারি না, ভালো কিছু খেতে পারি না। খেতে গেলেই শুধু মেয়েটার কথা মনে হয়। আমরা এখন গ্রামে চলে যাবো, আর ঢাকায় থাকবো না। যে শহর আমার মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে, সে শহরে আমি থাকবো না।’

সরকারি কিংবা বেসরকারি কোন অনুদানের কথা বললে তিনি বলেন, আমরা শুধু জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা পেয়েছি। সরকার কিংবা আর কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা আমরা এখনও পর্যন্ত পাইনি।

এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় আশপাশের প্রতিবেশী এবং নাঈমার সহপাঠীদের সাথে। সবার একটিই কথা, উত্তরায় প্রায় শতাধিক শহিদ হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতেই হবে স্বাধীন বাংলাদেশে। আমরা যদি এসব হত্যার বিচার করতে না পারি, তাহলে শহীদদের কাছে যে আমরা অনেক ছোট হয়ে যাবো। তাদের পরিবারের কাছেই বা কি জবাব দেবো?

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved , sokalerbangla.com
Theme Customized BY LatestNews