সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার নামে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতির মহোৎসব। হাসপাতালে ঢোকার মুহূর্ত থেকেই রোগী ও তার স্বজনদের ওপর নেমে আসে অর্থের চাপ। সেবার বদলে এখানে চলছে এক ধরনের ‘টাকার খেলা’।একজন ভুক্তভোগী জানান, ‘রোগী নিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ঢোকার সাথে সাথে ১০টাকার টিকেট কাটতে হয়। এরপর রোগীকে ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য হুইলচেয়ার বা ট্রলি নিতে হয়, যার জন্য দিতে হয় ১০০ থেকে ৩০০টাকা। রোগীর সাথে যদি একজনের বেশি প্রবেশ করে, তবে প্রতিজনের জন্য দিতে হয় ২০টাকা করে। এমনকি যদি বেড না পাওয়া যায়, তবে মাটিতেই ঠাঁই মিলবে।”আরেকজন স্বজন ক্ষোভের সাথে বলেন, “ডাক্তার প্রতিদিন বদলায়, আর প্রতিদিন নতুন নতুন পরীক্ষা আর ওষুধের প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরীক্ষা করাতে গেলেও ট্রলি বা হুইলচেয়ারের জন্য ১০০-২০০ টাকা দিতে হয়। দিন শেষে বুঝতে পারি, রোগীর সুস্থতার চেয়ে টাকা খরচের দৌরাত্ম্য বেশি!”অপারেশন হলে রোগীর আত্মীয়দের জন্য শুরু হয় আরেক দুঃস্বপ্ন। এক স্বজন বলেন, অপারেশনের আগে ৬০০০-৭০০০ টাকার ওষুধ কিনে ডাক্তারের হাতে দিতে হয়, যা ফেরতযোগ্য নয়। এরপরও থিয়েটারের কর্মচারী, দারোয়ান, ওয়ার্ডবয়-সবাইকে খুশি করতে হয়। রোগী মারা গেলে টাকা ও মানুষ সবই শেষ, আর বেঁচে গেলেও খরচের শেষ নেই।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়ার সময়ও চলে একই নাটক। এক রোগীর স্বজন জানান, নার্স, দারোয়ান, ওয়ার্ডবয়-সবার হাতে কিছু না কিছু দিতে হয়। সব মিলিয়ে এমন অবস্থা যে, শেষমেশ হাসপাতাল থেকে বের হলেই দেখি বিশাল ব্যানারে লেখা-‘আমি ও আমরা দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান’! আশাশুনি থেকে আসা মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, আমার বড় ভাই স্ট্রোক করে সাতক্ষীরা মেডিকেলে ভর্তি হন। প্রথম দিন থেকেই টাকা দিয়ে পথ খুলতে হয়েছে। জরুরি বিভাগে ঢুকেই ১০ টাকার টিকেট কাটলাম। তারপর ওয়ার্ডে নেওয়ার জন্য ট্রলি লাগবে, ওয়ার্ডবয় বললো ৩০০ টাকা দিতে হবে! দিতে না চাইলে রোগী বারান্দায় পড়ে থাকুক, এমন কথা শুনতে হলো! রোকেয়া বেগম (ছদ্মনাম) প্রসূতি রোগী বলেন, ডেলিভারির জন্য ভর্তি হলাম। ডাক্তার এসে ওষুধের বিশাল লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। বাইরে থেকে সব কিনতে হলো। বেডও পেলাম না, শেষে ৫০ টাকা দিয়ে একটা বেড পেলাম! নার্সদের খুশি করতে না পারলে ভালো সেবা মেলে না। কী করবো, গরিব মানুষ, সব মেনে নিতে হয়!
রোগীর স্বজন শারমিন আক্তার বলেন, অনেকদিন ধরে আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আসলে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থায় এতটাই খারাপ তা বলে বুঝাতে পারবো না। কয়েকদিন আগে আমার কাকিরে নিয়ে গেছিলাম, উনার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। একটা হুইলচেয়ার কিংবা টলির জন্য আমাদের যা ঘুরান ঘুরাইছিল তা বলবো বুঝানো সম্ভব না। আর নার্সদের ব্যবহার এতটাই খারাপ বলার বাইরে। আর ডাক্তার তো আসে বলতে গেলে ২-৫ দিন পরে। রোগী যদি মারাও যায় তাও ডাক্তারদের কোনো কিছু যায় আসে না। সবদিক থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অবস্থা অনেক খারাপ। ওয়ার্ড বয়, নার্স তারপরে আরও যারা আছেন তাদের বেশির ভাগ মানুষের আচার ব্যবহার অনেক খারাপ। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেটার জন্য সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যায়।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পতিচালক ডা: শেখ কুদরত ই খুদাকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে রিসিভ করেননি। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই চিত্র শুধু কয়েকজন ভুক্তভোগীর কণ্ঠ নয়, এটি প্রতিদিনের বাস্তবতা। সরকারি হাসপাতাল হয়েও যেখানে দরিদ্র জনগণ সেবা পাওয়ার কথা, সেখানে চলছে চরম অনিয়ম। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলছেন, এই দুর্নীতির লাগাম টানবে কে?